- “সন্দেহ নেই যে সর্বকালে আমাদের জন্ম দেয়া শ্রেষ্ঠ নারী পর্বতারোহী এলিসন হারগ্রিভস।”
- “লিঙ্গ বৈষম্যের উর্ধ্বে উঠে এলিসন ছিলেন অসাধারন এক পর্বতারোহী। পর্বতে তাঁর সফলতা প্রমাণ করে তিনি অধিকাংশের চেয়েই বেশী প্রতিভাবান এবং দক্ষ। সম্ভবত তাঁর আকাঙ্ক্ষা তাঁকে দগ্ধ করতো। এরই কোনটি তাঁকে উঁচুতে তুলেছে, কোনটি তাঁর প্রাণ নিয়েছে। সম্ভবত নিজের পরিবারের জন্য ভালো জীবনের নিশ্চিত করতেই তিনি এতো কম সময়ে এভারেস্ট এবং কে-টু এর মতো পর্বতে গিয়েছেন। আমরা কখনোই জানতে পারবোনা। তাঁর সাথে কান্টেঙ্গা আরোহণই আমার ক্লাইম্বিং ক্যারিয়ার এবং জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে দিয়েছে। আমি খুশি যে তাঁর সাথে আমি এটা ভাগ করতে পেরেছি।”
উক্তিগুলো যখন যথাক্রমে পর্বতারোহণে সর্বকালের শ্রেষ্ঠদের একজন স্যার ক্রিস বোনিংটন এবং ৮০ এর দশকে আমেরিকার অন্যতম সেরা ক্লাইম্বার মার্ক টোয়াইট করেন তখন মনের অজান্তেই তাঁর জন্য জেগে উঠে সমীহ, মূল্যায়ন করতে হয় ভিন্ন মাপকাঠিতে। যতই সেই সময়কার মিডিয়া দুই শিশু সন্তান রেখে পর্বতারোহণের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজের জন্য “খারাপ মা” উপাধি দিয়ে তাঁকে তুলাধুনো করুক না কেনো! প্রথম সন্তান টম ব্যালার্ড ৬ মাস গর্ভে থাকা অবস্থায় এলিসন আরোহণ করেন ভয়ংকর সুন্দর আইগারের নর্থ ফেস। সমালোচকদের পাত্তা না দিয়ে তিনি বলতেন “না, কারন তুমি যাই করোনা কেনো মানুষ তোমার ভূল খুঁজে বের করবেই।”
১৯৬২ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারী ইংল্যান্ডের ডার্বিশায়ারে জন্ম নেয়া এলিসন হারগ্রিভসের স্বপ্নের বীজ বপন হয় ছোটবেলায় পরিবারের সাথে এক হাইকিং এ গিয়ে এবং সেই বীজ বেড়ে উঠে স্কুলে আউটডোর শিক্ষকের হাতে। একদিন সেই বীজ বেড়ে উঠে যে তাঁকে পৃথিবীর শীর্ষে নিয়ে যাবে কেই বা ভেবেছিল!

পুরুষশাসিত পর্বতারোহণের জগতে এলিসন প্রথম বিস্ময় তৈরী করেন ১৯৯৩ সালের একই মৌসুমে (গ্রীষ্মে) সম্পূর্ণ একাকী আল্পসের বিখ্যাত ৬ নর্থ ফেস আরোহণ করে। এই অভিযান নিয়ে তিনি “এ হার্ড ডেইজ সামার” নামে বই লিখেন। যেকোন মানুষের জন্যই এই অর্জন সারাজীবনের সম্বল হলেও এলিসনের জন্য এটি ছিল শুরু মাত্র।
কিন্তু তাঁকে অমর করে দেয়া গল্পের পটভুমি কিন্তু সুউচ্চ পর্বতমালায়। ১৯৮৬ সালে ২৪ বছর বয়সে আমেরিকার লিজেন্ড মার্ক টোয়াইট, জেফ লৌয়ে এবং টম ফ্রস্টের সাথে প্রথম হিমালয়ে আসেন এলিসন এবং প্রথম অভিযানেই আরোহণ করেন কান্টেঙ্গা (৬৭৭৯ মিটার) এ এক নতুন পথে। ১৯৯৪ এর অক্টোবরে তাঁর স্বপ্নের উচ্চতা ছোঁয় এভারেস্ট। সেই যাত্রায় ৮৫০০ মিটার পর্যন্ত একাকী আরোহণ করে ঠান্ডায় কাতর হয়ে তাঁকে ফিরে আসতে হয়।
কিন্তু যার নাম ইতিহাসের পাতায় বিশেষভাবে উচ্চারিত হবার তিনি কি অপেক্ষা করতে পারেন! মাত্র ৬ মাস যেতে না যেতেই ১৯৯৫ সালের ১৩ই মে তিনি একাকী এবং কোন সহায়তা ছাড়াই এভারেস্ট আরোহন করেন, যাকে অনেকেই আবেগের বশে তুলনা করেন স্যার রেইনহোল্ড মেসনারের ১৯৮০ সালের এভারেস্ট একাকী আরোহনের সাথে। আবেগমুক্ত ভাবে বলা যায় দুইটি অভিযানের অনেক পার্থক্য এবং মেসনারের সেই আরোহন ভিন্ন আলোয় আলোকিত। মেসনার নর্থ রিজে নতুন রুটে প্রথম বর্ষায় সম্পূর্ণ মানব শূন্য পর্বতে অভিযান করেছিলেন। অন্যদিকে এলিসন নর্থ রিজে নিয়মিত পথ দিয়ে এডভান্সড বেসক্যাম্প পর্যন্ত সহায়তা নিয়ে ভরা মৌসুমে অভিযান করেছিলেন। কিন্তু এডভান্সড বেসক্যাম্পের উপরে রসদ বহন, খোঁড়াখুঁড়ি, রান্না, তাঁবু স্থাপন সবকাজ তিনি নিজেই একা করেছিলেন এবং ব্যবহার করেননি কৃত্রিম অক্সিজেন। ওই পথে আগে থেকে লাগানো দড়ি তিনি স্পর্শ করেননি, এমনকি এক তাঁবুর পাশ দিয়ে এগুনোর সময় তাঁবুতে থাকা পর্বতারোহীদের দেয়া হিম ঠান্ডায় লোভনীয় অফার – গরম চা, এর লোভও সামলেছিলেন বিশুদ্ধতা রক্ষার্থে। এই একাকী আরোহন কট্টর সমালোচক বাদে সবাইকেই স্তব্দ করে দেয়া এক অর্জন এবং দেশে ফিরে পান জাতীয় বীরের মর্যাদা। চূড়া থেকে তিনি বাচ্চাদের রেডিও বার্তা পাঠিয়েছিলেন “টম এবং কেট, আমার প্রিয় সন্তানেরা, আমি পৃথিবীর শীর্ষে দাঁড়িয়ে আছি এবং আমি তোমাদের প্রচণ্ড ভালবাসি।”

এলিসন হারগ্রীভস এর কে-টু এর গল্প নানা ছন্দে প্রতিধ্বনিত হয়। অন্যরা সবাই ফিরে গেলেও পাঁচ পুরুষ পর্বতারোহী সহ তিনি সেদিন এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কেন তাঁরা এমনটি করেছিলেন? এই ধরণের উচ্চ ঝুঁকি নেয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে যার অধিকাংশই আমাদের মতো নিরাপদ বাসস্থানে স্বত:স্ফূর্তদের কাছে হয়তো কখনোই বোধগম্য হবার নয়। কারণ খুঁজতে কিছুটা পিছনে যাওয়া যাক। তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে ২০ বছর বেশি বয়সী জিমের সাথে প্রেম করেন এবং পরে বিয়ে করেন। তাঁরা একসাথে ক্লাইম্বিং এবং ক্লাইম্বিং গিয়ারের দোকান চালাতেন। ৯০ এর দশকের বৈশ্বিক মন্দায় স্বামী জিম ব্যালার্ড সহ এলিসন ছিলেন ঋণের চাপে পিষ্ঠ। তাঁর পূর্ববর্তী অভিযানে অনুদান দেয়া ডার্বিশায়ারে জিমের ক্লাইম্বিং গিয়ারের দোকানও বন্ধ করে দিতে হয়। ঋণ পরিশোধে ব্যার্থ হওয়ায় ব্যাংক তাঁদের বন্ধকী বাড়িও দখল করে নেয়.। এলিসন তখন সবেমাত্রই পেশাদার পর্বতারোহী হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিলেন এবং এর মাঝেই পরিণত হন পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারীতে। স্বামী জিম বিভিন্ন সময় তাঁর গায়ে হাত তুলতেন। তাই অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আনতে ব্রিটেনের শীর্ষ নারী পর্বতারোহী হিসেবে নিজের নাম খোদাই করতে তিনি কৃত্রিম অক্সিজেন সহায়তা ছাড়াই একবছরেই একাকী আরোহনের সিদ্বান্ত নেন পৃথিবীর ৩ শীর্ষ পর্বত – এভারেস্ট, কে-টু এবং কাঞ্চনজঙ্গা। সহজ জিনিসের দিকে তাঁর আগ্রহ না থাকা সম্পরকে তিনি বলেছিলেন “যদি তোমাকে দুটি থেকে বেছে নিতে বলা হয়, কঠিনটিই বেছে নাও। কারন নাহলে তুমি পরে আফসোস করবে। কঠিনটি বেছে নিয়ে হেরে গেলেও স্বান্তনা থাকবে যে তুমি অন্তত চেষ্টা করেছিলে।”
এভারেস্ট আরোহনের একমাস পরই তিনি কে-টু আরোহন করতে এসে পড়েন পাকিস্তানে। সেখানে এক আমেরিকার দলের সাথে যোগ দিলেও এভারেস্টের মতোই তাঁর আরোহন একাকী, সহায়তা ছাড়া এবং কৃত্রিম অক্সিজেন বিহীন। কে-টু স্বভাবগতভাবেই এই অভিযানকেও খারাপ আবহাওয়ার চাদরে ঢেকে ফেলে। বেসক্যাম্পে বসে থাকা দিনে তিনি দিনপঞ্জীতে লিখেছিলেন “একদিকে বাচ্চারা, অন্যদিকে কে-টু -আমাকে খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে। দুই ভালবাসা আমাকে দুইদিক দিয়ে টানছে।”
ছবিঃ কে-টু বেসক্যাম্প থেকে স্বামী-সন্তানদের কাছে পাঠানো ফ্যাক্স
এরই মাঝে একটা ছোট্ট সুযোগ পেয়ে ব্রিটিশ পর্বতারোহী এলেন হিংক্স কে-টু সামিটের অর্জন ঝুলিতে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলেও এলিসন সহ বাকি দল আরো ভালো সময়ের অপেক্ষায় দিন গুনছিলেন। আগস্টের ৬ তারিখের মাঝে এলিসন দুইবার ক্যাম্প-৩ এবং একবার ৮০০০ মিটারের সামান্য উপরে ক্যাম্প-৪ পর্যন্ত ঘুরে আসেন। কে-টু এর সাথে অপেক্ষার খেলায় হেরে গিয়ে তাঁর দলের অনেকেই বাড়ির পথ ধরেন। কিন্তু দলের নেতা রব স্ল্যাটার এবং তিনি আরেকবার চেষ্টা করতে থেকে যান। বেসক্যাম্প প্রায় শূন্য হয়ে গেলেও আরেকটি দলের কয়েকজন অভিযাত্রীরাও শেষ চেষ্টা করতে অপেক্ষায় থাকেন।আবহাওয়া একটু সুযোগ দিতেই তাঁরা ৯ই আগস্ট শেষ আরোহন শুরু করে যখন ক্যাম্প-৩ এ পৌঁছেন তাঁরা দেখতে পান এক তুষারধ্বস ক্যাম্প-৩ গুড়িয়ে দিয়েছে। তাঁরা তাঁবু স্থাপনে ভুল জায়গা পছন্দ না করলেও ক্রমাগত তুষারধ্বসের কারণে আসলেই ভয়ংকর কে-টুতে ভালো জায়গা বলে কিছুই নেই। ঘন্টাখানেক তাঁবু খুঁজে হতাশ হয়ে আবারো আরোহন শুরু করে সৌভাগ্যক্রমে তাঁরা দেখতে পান ক্যাম্প-৪ এর উপর কে-টু তখনো ক্রোধের আগুন বর্ষণ করেনি। আগেরদিনের লম্বা সময় আরোহণে দলের শক্তি নি:শেষের দিকে। তাই ১২ই আগস্ট সুন্দর সকাল থাকার পরও তাঁরা শক্তি পুনরুদ্ধারে তাঁবুতে সেদিন বিশ্রামের সিদ্ধান্ত নেন।
১৩ আগস্ট রাত দুইটাই এলিসন বেরিয়ে পড়েন শীর্ষের লক্ষ্যে। সেদিন মোট ১১জন ক্যাম্প-৪ ছেড়ে বেরোলেও চূড়ার পথে সবচেয়ে বড় বাঁধা, বটলনেকে পৌঁছার আগেই স্যার এডমুন্ড হিলারির পুত্র পিটার হিলারি সহ ৫ জন ফিরে যান। এই সিদ্ধান্তই যুক্তিযুক্ত ছিল কারণ আবহাওয়া জানান দিচ্ছিলো চীনের দিক থেকে এগিয়ে আসছে ভয়ংকর ঝড়। এই ঝড় যখন পিটারকে ধরে ফেলে ততক্ষনে তিনি ব্ল্যাক পিরামিডের নিচে নেমে গিয়েছেন।
এই ঝড় যখন প্রতিবেশী ব্রডপিকে আঘাত হানে তখন সেখানে অভিযাত্রীরা নামার পথে দেখতে পান এক ভৌতিক দৃশ্য – কে-টুতে তখনো আরোহন করছেন ৬জন! এই দল সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ যখন পর্বত শীর্ষে পৌঁছান তখন সেখানে আবহাওয়া তুলনামূলক ভালো থাকলেও কেউ ধারণায় করতে পারেননি নিচ থেকে ধেয়ে আসছে মৃত্যু।

কিছুটা নেমে আসতেই তাঁদের কাছে পৌঁছে যায় ঝড়। নিজেদের নিরাপত্তার জন্য আঁকড়ে ধরার মতো কোন দড়ি বা আশেপাশে কোন নিরাপদ আশ্রয় না থাকায় এই ঝড়ের সামনে দাঁড়াতেই পারেননি এই ক‘জন মানবসন্তান। ঝড় তাঁদের একে একে উড়িয়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে সাউথ ফেইস এর দেয়াল দিয়ে। এলিসন ছাড়াও দুর্ভাগাদের দলে ছিলেন স্পেনের হাভিয়ের এস্কারটিন, হাভিয়ের অলিভার, লরেঞ্জো ওর্টিজ, নিউজিল্যান্ডের ব্রুস গ্র্যান্ট এবং আমেরিকার রব স্লেটার।
স্পেনের দলের বাকি সদস্যরা ১৪ই আগস্ট পর্যন্ত ক্যাম্প-৪ এ অপেক্ষা করে তাঁদের দেখা না পেয়ে নিয়তি বুঝতে পেরে নামা শুরু করেন। ১৫ই আগস্ট ক্যাম্প-২ এ মৃত্যুবরণ করেন কানাডার জেফ লেক্স।
ক্যাম্প-৪ থেকে নামার পথে স্পেনের পর্বতারোহীরা দেখতে পান এলিসনের পরিচিত জুতা পরে আছে পথে। চারপাশে ভালো মতো খুঁজতেই দেখা মিলে ৩০০ মিটার দূরে এক দুর্গম স্থানে পরে আছে সবুজ কাপড় পরিহিত এলিসনের নিথর দেহ। ক্লান্তিতে এবং উদ্বার অসম্ভব জেনে যখন তাঁরা আবারো নামা শুরু করেন তখন সেই স্থানেই চিরনিদ্রায় শায়িত হবার স্থান নির্ধারিত হয়ে যায় ব্রিটেনের শ্রেষ্ঠ নারী পর্বতারোহীর।
মাত্র ৩৩ বছর বয়সে মহাপ্রয়াণের সময় এলিসন পৃথিবীতে রেখে যান তাঁর একমাত্র পুত্র ৬ বছর বয়সী টম ব্যালার্ড এবং ৪ বছর বয়সী একমাত্র কন্যা কেট ব্যালার্ডকে। রক্তের টানেই হয়তো কেট হলেন একজন ক্লাইম্বার এবং স্নো-বোর্ডারার এবং টম হয়েছিলেন আল্পসের ভয়ঙ্কর ৬ নর্থ ফেসে মায়ের স্মরণে প্রথম এক শীতে একাকী আরোহন করা, আল্পস ধাপিয়ে বেড়ানো পর্বতারোহী। টম প্রসঙ্গে বাবা জিম বলেছিলেন “যতটুকু মনে পড়ে টম ক্লাইম্বার ছাড়া কখনোই আর কিছু হতে চায়নি এবং সে সেটাই হয়েছে।”
টম ২০১৯ এর ফেব্রুয়ারীতে ইতালির ডেনিয়েল নার্ডির সাথে নাঙ্গা পর্বতের মামেরি স্পারে প্রথম শীতকালীন আরোহন অভিযানে আসেন পাকিস্তানে। মায়ের মৃত্যুর ২৪ বছর পর সেই অভিযানে একই দেশে মায়ের নিকটবর্তী পর্বতে চিরতরে শায়িত হন তাঁর প্রিয় সন্তান। মা-ছেলে দুইজনই ক্ষণজন্মা হলেও বেঁচে ছিলেন বাঘের মতোই। কারন এই পর্বতারোহী মা ও প্রথা ভাঙ্গা নারী বিশ্বাস করতেন “বাঘের মতো একদিন ভেড়ার মতো হাজার দিনের চেয়েও উত্তম”।